‘মিডিয়া’ বা ‘মাধ্যম’ পরিভাষাটি যোগাযোগের সমস্ত প্রকার পন্থাকে বোঝানো হয় যেগুলির সাহায্যে কোনো বার্তার স্থানান্তর সম্ভব। এগুলি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম হতে পারে। প্রচলিত ভাষায় ‘মিডিয়া’ বা ‘মাধ্যম’ বলতে সাধারণত গণমাধ্যমকে বোঝানো হয়, যার সাহায্যে দ্রুত বিপুল সংখ্যক জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।
বর্তমান যুগে প্রধান প্রধান গণমাধ্যমগুলি হলো: পোষ্টার, প্রকাশনা, বেতার, টেলিভিশন, ওয়াল্ড ওয়েব বা ইন্টারনেট, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ইত্যাদি। অপরদিকে, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ একটি নৈতিক পরিকাঠামো যা অনুযায়ী প্রতিটি ব্যক্তির অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠনসমূহের সাথে একত্রে কাজ করা উচিত যাতে বৃহত্তর সমাজের লাভ হয়। …এই দায়বদ্ধতা সক্রিয় ধরণের হতে পারে, যেমন সামাজিক লক্ষ্য পূরণের জন্য নির্দিষ্ট কর্মকান্ডে যোগদান করা। এই দায়বদ্ধতা নিষ্ক্রিয় ধরণেরও হতে পারে, যেমন সামাজিকভাবে ক্ষতিকর কর্মকা- থেকে বিরত থাকা। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অবশ্যই আন্তঃপ্রজন্ম হতে হয়। কেননা এক প্রজন্মের কাজ এক বা একাধিক প্রজন্মের উপর প্রভাব ফেলতে পারে’ (Palmer Karen, 1995)। এ কথাটি মনে রেখেই, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বলতে গেলে ‘সামাজিক দায়িত্ব’ ও ‘মিডিয়া’ দু’টি শব্দের উপস্থিতি নিবিড়ভাবে জড়িত। একটি অপরটি ছাড়া ভারসাম্যহীন। অচলপ্রায়।
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণমাধ্যম ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে। বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদপত্র স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে কোনভাবেই গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গণমাধ্যম শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকরী সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
জ্ঞানই শক্তি। আর এই জ্ঞান ছড়ানো ও জ্ঞানার্জনের একটি অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে, পত্র পত্রিকা প্রকাশনা ইত্যাদি থেকে অবারিত জ্ঞানের সাগর থেকে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারেন। গণমাধ্যমগুলো বৈচিত্র্যময় স্বতঃস্ফুর্ত, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক, পান্ডিত্যপূর্ণ-অপান্ডিত্যপূর্ণ সব ধরনের লেখাকেই ধারণা করে ও বিকাশের সুযোগ করে দেয়।
সংবাদপত্র, পোস্টার, বিলবোর্ড, দেয়াল লেখনি ও ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি জ্ঞানের মুক্তমঞ্চ হিসেবে গণনা করা হয়। এখানে একজন লেখক তার লেখনীকে কাঙ্খিত গ্রাহকের কাছে খুব সহজেই তুলে ধরতে পারেন। এ মাধ্যমগুলি যারা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন, তাদের শিক্ষা বা জ্ঞানবুদ্ধির পুঁজিকে বাড়িয়ে তোলার শক্তি রাখে। অপরদিকে, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ইত্যাদি মাধ্যম দ্বারা নিরক্ষররাও উপকৃত হতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে এমন একটি মাত্র মাধ্যম দ্বারাই একটা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিবিসি বেতার অনুষ্ঠান শোনার জন্য হাটের বদলে হয়েছিল ‘বিবিসির হাট’।
মিডিয়া বিশেষত, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যম সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার স্বরূপ। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যোগাযোগবিদ ড্যানিয়েল লার্নার গণমাধ্যমকে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে, মানুষকে সমৃদ্ধ জীবনের ছবি দেখায় ও গতানুগতিক জীবনের বদ্ধ পরিধি থেকে মুক্ত করে ঐশ্বর্য্যময় আধুনিক জীবনের দিকে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করে। লার্নার মনে করেন, উন্নয়নে গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে মানসিক গতিশীলতা বাড়ায়। এই মনস্তাত্ত্বিক গতিশীলতা উন্নয়নের আবশ্যিক উপাদান। তাই গণমাধ্যমকে বলা হয় ‘ম্যাজিক মাল্টিপ্লায়ার’ (লার্নার, ১৯৫৮)। বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক পল মিশেল বলেন, ‘Change cannot happen without communication…we want to make communication a pillar of development’. এ কথাটি বোধ হয় নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা, সুন্দর সাবলীল যোগাযোগ ছাড়া সমাজের প্রকৃত পরিবর্তন অসম্ভব। তাই যেকোনো দেশের উন্নয়নের স্তম্ভ হিসেবে যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে।
সমাজের যোগাযোগ মাধ্যমগুলি সমাজ ও রাষ্ট্রে ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে আমাদের চারপাশের চলমান ঘটনা বিভিন্ন বিষয় নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করে সামাজিক অন্যায় ও অসঙ্গতি দর্শকদের সামনে দর্পনের ন্যায় তুলে ধরে এবং সমাজকে সতর্ক করতে উদ্যেগী হয়। এছাড়াও এর মাধ্যমে সমাজের নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের দাবি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, ৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী অসাম্প্রদায়িক চেতনার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সহশিল্পের উন্নয়ন, শ্রমিক মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু দাবী আদায়, জনমত সৃষ্টি তৈরি করেছে।
এমনকি রাজনৈতিক দলগুলির সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন মিডিয়ার ব্যবহার ও গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক কালে করোনা মহামারীতে মিডিয়ার ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের বিভিন্ন দিক এবং এ সম্পর্কিত নানা তথ্য তৃণমূলের জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। করোনা সম্পর্কিত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ প্রচার ও প্রসারে মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়াও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা যেমন অনলাইন বিজনেস, পণ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, বাজার সৃষ্টি ইত্যাদি কার্যক্রম এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনেও মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
সামাজিক দায়িত্ব পালনে মিডিয়া ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। নেতিবাচক ব্যবহার বা নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধানো যায়, উদাহরণ হিসেবে ‘স্প্যানিশ-আমেরিকান’ যুদ্ধের কথা বলা যায়। অভিযোগ আছে, ‘এ যুদ্ধে উৎসাহ যুগিয়েছিল হলুদ সাংবাদিকতা’ (www.pbs.org)। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, কুসংস্কারকে ছড়িয়ে দিতে মিডিয়ার ব্যবহার একটি সহজ প্রক্রিয়া। এছাড়াও মিডিয়া কখনও কখনও অপ্রয়োজনীয় ভুল, মিথ্যা ও ভ্রান্ত তথ্য সরবরাহ করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে, আমাদের দেশে হলিআর্টিজেন বেকারিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা যেখানে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু যুবক। আক্রমণকারীদের জঙ্গি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার একটি অন্যতম হাতিয়ার ছিল মিডিয়ার ব্যবহার। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, ছবি ভিডিও শেয়ার করে সময় নষ্ট করা একটি অন্যতম বিষয়। আর এ সুযোগটি করে দিচ্ছে ইন্টারনেট।
‘সারা বিশ্বে ৭০% মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০%। বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ১৩-১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৬০% এর বেশি অন্তত একটি সামাজিক যোগাযোগ প্রোফাইল রয়েছে। তারা দিনে ২ ঘন্টার বেশি এটি ব্যবহার করে’ (যুগান্তর, ৩০ নভেম্বর ২০১৮)। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের জরিপ অনুযায়ী ‘ঢাকা ও আশেপাশের অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন’ (দৈনিক বণিক বার্তা, ১৯ সোপটেম্বর ২০১৭)। এ সকল যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার দিনদিন আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইউটিউব, হোয়াটসআ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদির ব্যবহার দিনদিন যেমন বেড়ে চলেছে তেমনি এর ক্ষতিকর প্রভাবও ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে সমাজের সর্বত্র। এখনই সময় এর রাশ টেনে ধরার না হলে হয়তঃ নিয়ন্ত্রেণের বাইরে চলে যাবে। আর একবার নাগালের বাইরে গেলে ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হতে পারে।
যদিও মিডিয়ার ক্ষতিকর ব্যবহার ও অপপ্রচার দিনদিন বেড়েছে তথাপি বর্তমান আধুনিক যুগে সামাজিক উন্নয়ন ও দায়িত্ব পালনে মিডিয়ার গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। তাই বলা যেতে পারে মিডিয়ার অনৈতিক যথেচ্ছা ব্যবহার ও অসামাজিক চেতনাকে দূরে ঠেলে এর কাঙ্খিত ও সুষ্ঠু ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করা উচিৎ। এটি এখন সমাজে সময়ের দাবি সকল সচেতনমহলে।
২০২০ সালের জুলাই মাসে করোনার মধ্যে মানুষ যখন অস্থির ও ভয়কাতুরে স্বভাবের মানুষের মতো হয়ে পড়েছে তখনই ‘খুলনা গেজেট’ আত্মপ্রকাশ করে স্বমহিমায়। এই নিউজ ওয়েব পোর্টালটির শুরুতে শ্লোগান ছিল ‘সবার আগে, সঠিক খবর’। আশা করি খুলনা গেজেট প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে। সময়ের দাবি হিসেবে এখন ডিজিটাল যুগে সংবাদপত্রগুলি সব অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিপনন করছে। প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্তিতে এই নিউজ ওয়েব পোর্টালটি সমধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের জন্য। সামাজিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে পোর্টালটি ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে নানান বিষয়ের অনুসঙ্গকে ধারণ করে নিয়মিত তথ্য দিচ্ছে। খুলনা বিভাগের প্রতিটি জেলার জন্য রয়েছে ভিন্ন সেকশন। এ ছাড়াও এ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমেও সংবাদ সরবরাহ করছে প্রতিনিয়ত। অত্যন্ত ভালোলাগার বিষয় পোর্টালটির রয়েছে আর্কাইভের ব্যবস্থা। পাঠকের তথ্য খুঁজে পাবার একটি নির্ভরযোগ্য স্টোরহাউজ।
একজন পাঠক ও শুভাকাঙ্খি হিসেবে আশা করি খুলনা গেজেট এর সংবাদকর্মীরা সত্য ও ন্যায়কে দায়িত্বশীলতার সাথে জনমানুষের সামনে তুলে ধরবেন। খুলনা গেজেটের এক বছর পূর্তি ও দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ হিসেবে একটাই চাওয়া, একটি দায়িত্বশীল পোর্টাল হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা। জয় হোক খুলনা গেজেটের।
(লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)